এখনো পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ James Webb Space Telescope। সংক্ষেপে JWAT। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। যদিও পুরো নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। জেমস টেলিস্কোপের আগে সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপটি ছিল হাবল টেলিস্কোপ। আমেরিকান বিজ্ঞানী এবং এসট্রনোমার হাবলের নামানুসারে করা সাত ফিট দশ ইঞ্চি উচ্চতার মিররে তৈরি হাবল টেলিস্কোপটি আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ১৯৯০ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। হাবল টেলিস্কোপ যদিও এখনো ডাটা পাঠিয়ে যাচ্ছে, হাবলের চেয়ে শক্তিশালী মিরর বসানো জেমস টেলিস্কোপ ইউনিভার্সের আরও গভীরে পর্যবেক্ষণের সুবিধা নিয়ে বানানো হয়েছে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নেয়া হয়েছে নাসার দ্বিতীয় এডমিনিস্ট্রেটর হেড James Edwin Webb এর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নাসার কাজের কৃতিত্বকে স্মরণে। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান। ২০০২ সালে প্রথম প্রস্তাব করা হয় নেক্সট স্পেস টেলিস্কোপের নাম হবে তার নামানুসারে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি তিনটি দেশের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে। আমেরিকার NASA, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ESA, এবং কানাডার CSA -এর অর্থায়ন এবং বিজ্ঞানীদের উদ্যোগে। টেলিস্কোপটি গতবছরের খ্রিস্টমাসের দিন ফ্রেঞ্চ গায়ানার Kourou স্পেসপোর্ট থেকে স্পেসের উদ্দেশ্যে Ariane VA256 নামের দুটি ফুয়েল ট্যাংক সমৃদ্ধ দুটো রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপণ করা হয়।
টেলিস্কোপটি তৈরি করতে মোট খরচ হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার মাত্র। খরচ বিশ গুন বেড়ে যায় এই সময়ের মধ্যে। মূল কাজ শুরু হয় ১৯৯৬, শেষ হয়েছিল ২০১৬ সালে। বিশ বছরের বিভিন্ন সময় সমন্বয়কারী দেশগুলো প্রকল্পটি বন্ধের হুমকি দিয়েছিলো খরচ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায়। এটি তৈরি করতে ২০ বছরে ১৪ টি দেশের ২৫৮ টি কোম্পানির ১০ হাজার বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানের সাহায্য লেগেছে।
জেমস টেলিস্কোপ একুশ শতকের হলেও সতেরো শতকে ১৬০৮ সালে নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানী Johann Lippershey, যার আসল নাম যদিও ছিল Hans Lippershey, সর্বপ্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। জনের আবিষ্কৃত প্রথম টেলিস্কোপটি ছিল রিফরেক্টিং টেলিস্কোপ। পরবর্তীতে ইতালিও বিজ্ঞানী গ্যালিলিও ১৬০৯ সালে জনের টেলিস্কোপটির কিছু উন্নতি সাধন করে নতুন আরেকটি তৈরি করেন।
চারশো বছর আগে যে টেলিস্কোপ জনের হাত ধরে শুরু করেছিল মহাকাশে চোখ রাখতে, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে জেমস টেলিস্কোপে।
জেমস টেলিস্কোপটি স্পেসে রাখা হয় বলে স্পেস টেলিস্কোপ বলে। মহাকাশের বিস্তৃতিকে সার্ভে করা থেকে মহাকাশ শুরুর কাছাকাছি সময় পর্যন্ত আলোর অস্তিত্বকে পর্যবেক্ষণ করবে এই টেলিস্কোপ। আমেরিকান এস্ট্রোনোমার লেহম্যান স্পিৎজার জুনিয়র ১৯৪৬ সালে স্পেস টেলিস্কোপের আইডিয়াটি সর্ব প্রথম প্রকাশ করলেও, তারও ২৩ বছর আগে ১৯২৩ সালে বিজ্ঞানীরা তত্ত্বীয় ভাবে স্পেস টেলিস্কোপের ধারণাটি প্রথম প্রকাশ করেন।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মূল মিশন পিরিয়ড ১০ বছর। যদিও বিজ্ঞানীরা আশা করছেন সবকিছু ঠিক মতো চললে আরও বেশি সময় এটিকে কার্যকর রাখা সম্ভব হবে । মেরিল্যান্ডে টেলিস্কোপটির মূল কন্ট্রোল সেন্টার। পাঠানোর তারিখ থেকে দশ দিন পর প্রথমে দ্বিতীয় মিররটি ওপেন করা হয়েছে এবং তার দু দিন পর মূল মিররটি ওপেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি ১১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সইতে পারে এবং – ২৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠাণ্ডায় কাজ করতে পারে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি যে পয়েন্টে রাখা হবে স্পেসে তার নাম: Lagrange point বা L2, যেখানে গ্র্যাভিটেশন ফোর্স টি তুলনামূলক স্থির। এই পয়েন্ট পৃথিবী থেকে দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। এটি তার মূল কাজ শুরু করতে গিয়ে ৩০০ টি ভুলের সম্মুখীন হতে পারে! ঠিকমতো কাজ শুরু করতে ১৭৮ টি মুভমেন্ট এবং মেকানিজম করতে হবে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি Dietrich Korsch এর ১৯৭২ সালে প্রস্তাবিত Korsch টেলিস্কোপের আদলে দুটি মিররের সমন্বয়ে তৈরি টেলিস্কোপ। মিররগুলোতে ক্ষীণ আলোকে আরও স্পষ্ট করে ধরার জন্যে ইনফ্রারেড রেজুলূশন ক্যাপাসিটি বাড়ানো হয়েছে। মূল মিররটি আলো সংগ্রহের আসল কাজটি করে। প্রাইমারি মিররটি বড় এবং এর দৈর্ঘ্যে একুশ ফুটের বেশি। হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে ছয় গুন বেশি আলো সংগ্রহের ক্ষমতা সম্পন্ন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে Mid-Infrared Instrument জাতীয় শক্তিশালী মিরর বসানো। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মূল আয়নাটি ১৮টি হেক্সাগয়নাল সেগমেন্টে ভাগ করা, মোট দৈর্ঘ্য ২১ ফুট ৪ ইঞ্চি । গোল্ড প্লেটেড বেরিলিয়াম উপাদান দিয়ে তৈরি আয়নাটি। হাবল টেলিস্কোপ ছিল ৭ ফিট ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যর মিরর। সব মিলে হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে জেমস টেলিস্কোপ ছয় গুন বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারে।
পৃথিবী থেকে স্পেসকে দেখতে গেলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে ধূলিকণা, মেঘ থেকে আলোর প্রতিফলন, অনেককিছুই স্পেসকে পর্যবেক্ষণে বাধা দেয়। তাই পৃথিবী থেকে একটি দূরত্বের উচ্চতায় টেলিস্কোপটি রেখে মহাকাশকে ভালোভাবে দেখা যায়। এমন করে আউটার স্পেসে রাখা প্রথম টেলিস্কোপ ছিল OAO-2 বা Orbiting Astronomical Observatory 2, যা আমেরিকা ১৯৬৮ সালে তৈরি করে। পরবর্তীতে সোভিয়েত রাশিয়াও ১৯৭৪ সালে Orion 1 নামের স্পেস টেলিস্কোপটি মহাকাশে প্রথমবারের মতো প্রেরণ করেন।
২০২১ সালের খ্রিষ্টমাস দিনে স্পেসে বসানোর উদ্দেশ্যে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এর আগে অনেকগুলো তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু কিছু টেকনিক্যাল কারণে ডিসেম্বরের শুরুতে উৎক্ষেপণের তারিখ থাকলেও পরবর্তীতে মাসের শেষে প্রেরণ করা হয়।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের অনেকগুলো কাজ। বিশেষ করে বিগ ব্যাঙ সময়ের পর পরই প্রথম তারার আলোটি কেমন ছিল, কি করে সেই তারা থেকে অসংখ্য তারা হল, সেই তারাগুলো এক হয়ে কি করে জন্ম নিলো প্রথম গ্যালাক্সি, সেই গ্যালাক্সির ভেতর কি করে তৈরি হতে থাকলো প্ল্যানেট। ইউনিভার্সকে আরও ভালোভাবে দেখা, বিশ্লেষণ করা, উপাত্ত সংগ্রহ করা, ইউনিভার্সের কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তার অনুসন্ধানে কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া, মহাকাশের বিশাল ধূলিকণা আর গ্যাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোটি কোটি মাইল দূরের কোটি কোটি তারার খোঁজ পাওয়া জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের কাজ।
হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে ১৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বছর আগের আলো দেখা সম্ভব ছিল। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন বছর আগের আলো দেখা সম্ভব। বিগ ব্যাঙ হয়েছিল ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগে। তার মানে ইউনিভার্স শুরুর ১০০ মিলিয়ন বছর পরে যে প্রথম তারাটির জন্ম হয়েছিল, তার সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে। সেই সাথে প্রথম গ্যালাক্সি কিভাবে তৈরি হয়েছিল, তার উপরেও জানা যাবে। এটির মাধ্যমে ডাটা কালেক্ট করতে পারলে ইউনিভার্সের গঠনের রহস্যের সাথে ডার্ক ম্যাটার, ইউনিভার্সে প্রাণের অস্তিত্ব এবং ইউনিভার্সের শুরুর সময়টি কেমন ছিল, এমন বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে। আর এই রহস্যের উন্মোচন দেবে সেই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর – কেন ইউনিভার্স তৈরি হয়েছিল।
সুত্র-ইত্তেফাক
Leave a Reply