বছরের কোনো কোনো সময়ে পত্রপত্রিকায় ‘বাজারে আগুন লেগেছে’, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী’, ‘সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস’ জাতীয় শিরোনাম দেখা যায়। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, সবজির দাম সাধারণ মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে। তবে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাজারে চালের দাম বাড়লে। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৭ শতাংশ। দেশের জনগণের দৈনিক ক্যালরির ৭০ শতাংশের বেশি আসে এই চাল থেকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ মাথাপিছু বার্ষিক চাল ভোগে এশিয়ায় দ্বিতীয়, যা প্রায় ১৮০ কেজি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে চাল উৎপাদন তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ভুট্টা উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে চাষযোগ্য জমি ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে এখনো মোট চাষযোগ্য জমির ৭৭ শতাংশ ধান উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে। ধান উৎপাদন কৃষি জিডিপির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ, মোট গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ৫০ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ গ্রামীণ খানা আয়ে অবদান রাখছে। সুতরাং খাদ্যনিরাপত্তার জন্য চাল বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধান উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। চাল শুধু কৃষিপণ্য নয়, রাজনৈতিকভাবে অতিসংবেদনশীল পণ্য।
আমাদের দেশে বাজারে চালের দাম বাড়লে পত্রপত্রিকায় বলা হয়, এটা ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট’। তারাই চাল মজুদ করে রাখে এবং মজুদ বৃদ্ধির মাধ্যমে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তখন সরকারি কর্মকর্তা গুদামে হানা দেন। আবার অনেক সময় দেখা যায় বাজারে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেন। আমাদের বোঝা উচিত অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপে এভাবে বাজার ব্যবস্থা চলে না। বাজার তার নিয়মে চলে। সেটি হলো চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয় হয়েই দাম নির্ধারিত হয়। কাজেই এর বাইরে কাজ করতে গেলে বা বাজারকে বাধা দিতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বাংলাদেশে হচ্ছেও তাই। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সত্য যে চালের বাজারদর সাধারণত মিল মালিকদের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে (খাদ্য অধিদপ্তর) চালের মিলের সংখ্যা ১৮ হাজার ৪০৯ (জুন ২০২১)। তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয় চাল মিলের সংখ্যা ২ হাজার ৮৪৭, আধা স্বয়ংক্রিয় ২ হাজার ২৩৮টি (রাবার পলিশার ও পলিশিং যুক্ত)। সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের চালের বাজার অনেকটা পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত পূর্ণ প্রতিযোগিতার কাছাকাছি। এর বড় বৈশিষ্ট্য হলো বাজারে অসংখ্য বিক্রেতা ও ক্রেতা এবং মধ্যস্বত্বভোগী। পণ্য চলাচলে ও প্রক্রিয়াকরণে মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারে মূল্যশৃঙ্খলে বড় অবদান রাখে। তাদের মাধ্যমে চাল কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে চলে আসে। বলা যায়, মধ্যস্বত্বভোগীরা যদি অত্যধিক লাভ করত তাহলে বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের পরিমাণ আরো অনেক বেশি বেড়ে যেত। অন্যান্য খাতের লোকজন এ খাতে আরো চলে আসত। ২০১২-১৪ এ সময়ে স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে বরং ছোট ও মাঝারি ১২ হাজারের অধিক সাধারণ মিল বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ চালের বাজারে প্রবেশ ও বের হওয়া উন্মুক্ত (easy entry, easy exit), যা প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশে মোটাদাগে তিন ধরনের চাল উৎপাদন হয়—আউশ, আমন ও বোরো। আউশ রোপণ করা হয় মার্চ থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত আর কাটা হয় জুলাই-আগস্টের দিকে। আমনের ক্ষেত্রে রোপণ শুরু হয় মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আর তা কাটা হয় নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। বোরোর রোপণ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি আর ধান তোলা হয় এপ্রিল-মে মাসে। ধান উৎপাদনে কাছাকাছি তিনটি মৌসুম হওয়ায় চাল দীর্ঘকালীন মজুদের সুযোগ কম। ব্যবসায়ীরা এই দীর্ঘকালীন মজুদ করে না। মজুদ আইন সে কারণেই প্রয়োগের সুযোগ কম। ধান তোলার আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চ বাজারে চালের সরবরাহ কম থাকে এবং এ সময়ে কিছু মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে। পরবর্তী সময়ে ধান তোলার পর বাজারে জোগান বেড়ে যাওয়ার ফলে দাম ধীরে ধীরে কমে যায়। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র চাষী (১ হেক্টরের কম জমি)। এদের বেশির ভাগ নিতান্ত টিকে থাকার জন্য ধান উৎপাদন করেন। সেক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত থাকে খুব কম। তারা বেশির ভাগ সময় বাজার থেকে চাল ক্রয় করেন, তাছাড়া তাদের জায়গাস্বল্পতায় ধান গুদামজাতের সুযোগও খুব কম। তবে আমাদের দেশের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎপাদকের স্বার্থকে বড় করে দেখা হয়, ভোক্তাদের কথা পরে আসে। দাম বাড়লে সংখ্যায় কম উদ্বৃত্ত কৃষকের আয় বাড়ে, অন্যদিকে খাদ্যের দাম বাড়লে প্রায় ১৭ কোটি ভোক্তার মধ্যে নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। খুব প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় এমনিতে ধান চাষ অন্যান্য কৃষিপণ্যে, যেমন সবজি, ফলের তুলনায় কম লাভজনক। সরকারি হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি বোরো উৎপাদনে খরচ ৩৯ টাকা। অন্যদিকে একই অর্থবছরে প্রতি কুইন্টাল (১০০ কেজি) মোটা চালের খুচরা মূল্য ৪ হাজার ৮১ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজি প্রায় ৪১ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে জনসংখ্যা ১৬৯ মিলিয়ন, এর জন্য নিট খাদ্যশস্য প্রয়োজন ৩১ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন টন। আবার এ সময়ে নিট খাদ্যশস্য উৎপাদন ৩৮ মিলিয়ন টন (যার মধ্যে চাল উৎপাদন ৩৪ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন টন)। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন, তার মধ্যে চালের পরিমাণ মাত্র ৪ হাজার ৩০০ হাজার টন। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের খাদ্য বিশেষ করে চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে। এ তথ্য বলে দেয়, উৎপাদন তথ্য সঠিক হলে চালের দাম বৃদ্ধির ঘটনা হওয়া উচিত সাময়িক এবং তা অনেকাংশে বাজারে চাহিদা ও জোগানের ওপর হবে নির্ভরশীল। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কৃষিজ পণ্যের দাম বেড়ে যায়। চালের উদ্বৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন মৌসুমেই দেখা যায় মোটা চালের দাম বাজারে বৃদ্ধি পায়; যা এই ভরা আমন মৌসুমেই ৫৫-৫৬ টাকা, ব্যাপারটা খাদ্য ঘাটতিজনিত নয়, এখানেই অটো মিল মালিক ও সেমি অটো মিল মালিকদের দায়ী করা যায়। তবে সেটা সিন্ডিকেশন করে নয়, বরং মুনাফার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে। আমাদের দেশে ‘মিনিকেট’ চিকন চালের ব্যাপক প্রচলন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উৎপাদনে এমন কোনো ধান জাত নেই। মিলাররা মোটা চাল কেটে কৃত্রিমভাবে মসৃণ করে, মিনিকেট, চিকন নাজিরশাইল ও বাংলাদেশী বাসমতী নামে বিক্রি করেন। ভোক্তাদের ঠকানো এ প্রক্রিয়ায় মোটা চালগুলো মসৃণ চিকন চাল হয়ে যায়। প্রতি কেজি মোটা ধান ক্রয় করে তা ডায়মন্ড, হরিণ, রশিদ ইত্যাদি ব্র্যান্ডের মিনিকেট ৬৫-৬৭ টাকা কেজিতে বিক্রি করে মুনাফা করেন এবং এভাবে মোটা চালের সরবরাহ কমে ভরা মৌসুমেই মিলাররা দাম বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি করেন। আমাদের দেশে চালের দাম ভরা মৌসুমে বেড়ে যাওয়ার এটাই বস্তুনিষ্ঠ ইতিবৃত্ত। এ বাজার প্রতারণা অবশ্যই বন্ধ করতে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন করতে হবে। চাল উৎপাদনের জাতভিত্তিকই বস্তাবন্দি হবে এবং জাতের নামেই বাজারে বিক্রি করতে হবে। যেমন বিআর ২৮, বিআর ২৯, বিআর ৭৪, বঙ্গবন্ধু-১০০ জাত ইত্যাদি।
এরপর কার্যকর ও লাভজনক কৃষির দিকে যেতে হলে আমাদের সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, কৃষক বা উৎপাদনকারীদের কম খরচে অধিক ফলন লাভের জন্য অধিক মনোযোগী হতে হবে। কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের অবশ্যই জবাব খুঁজতে হবে যে অত্যধিক ভর্তুকি দেয়া সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশে প্রতিবেশীদের থেকে চালের একরপ্রতি উৎপাদন খরচ বেশি। অধিক উৎপাদনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি ভালো মানের বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। খরচ কমানোয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। আমাদের দেশের উপযোগী কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উদ্ভাবন এবং তা বাণিজ্যিকীকরণে নজর দিতে হবে। এর সঙ্গে কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা পৌঁছানোর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র পরিসরের খামার মেশিন, মেকানিকস সেবা এবং মেশিন মেরামতের ওপর কৃষকদের এবং যন্ত্র ব্যবসায়ীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, যা আগেই বলেছি, আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থা প্রতারণাপূর্ণ। কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। এ প্রক্রিয়াগুলোকে সহজতর ও ঝামেলাবিহীন করার জন্য সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার থেকে গভীর পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিকতর সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে পরিবহন পর্যায়ে অন্যায় চাঁদাবাজিতে চালের খুচরা বিক্রয় দাম বেড়ে না যায়। লবণে আয়োডিন, ভোজ্যতেলে যেভাবে আইন করে ভিটামিন-এ সংযুক্ত করা হচ্ছে, সেভাবেই চাল-আটায় জিংকসহ অন্যান্য মাইক্রো পুষ্টি উপাদান ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে আইন করে সংযুক্ত করতে হবে, যা এখানে স্মরণযোগ্য।
ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যশৃঙ্খলে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সে ব্যাপারে নিয়মিত তদারক ব্যবস্থা জোরদার করা থেকে বাজার অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ, কৃষক পর্যায়ে মজুদ সুবিধা বৃদ্ধির দিকে সরকারকে অধিকতর দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকার খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রতি বছর প্রচুর ভর্তুকি দেয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। নীতি পর্যায়ে সরকার অষ্টম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন আগামী পাঁচ বছর নিম্নবর্ণিত কৌশল অবলম্বন করবে, যা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতি একর উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনবে।
ক) ফসলের উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যের সহজলভ্যতা, খাদ্যের অধিক ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা; খ) প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ প্রযুক্তি পরিষেবাগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের সক্ষমতা ও আয় বৃদ্ধি এবং বাজার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা; গ) পুষ্টিকর, নিরাপদ ও চাহিদা রয়েছে এমন খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা; ঘ) স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্য রফতানিতে উৎসাহ দেয়ার জন্য কৃষি গবেষণা আধুনিকায়ন, শিক্ষা, সম্প্রসারণ, উপকরণ ব্যবস্থাপনা ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির উন্নয়ন; ঙ) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিপণ্যের স্বচ্ছ বিপণন সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে কৃষকদের সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখা; চ) কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ব্যয় সাশ্রয়ী চাষ পদ্ধতি চালু করা; ছ) ভূমি, পানি এবং অন্যান্য সম্পদের আরো দক্ষ ও সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে অবশ্যই টেকসই কৃষি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্যমান সেচ ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে এনে সেচকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান; জ) ক্ষুদ্র সেচের জন্য সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনে গ্রামীণ এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদান; ঝ) কৃষি ক্ষেত্রে ন্যানো-টেকনোলজির প্রবর্তন, বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি প্রযুক্তিকে উৎসাহ প্রদান, খরা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্তপ্রবণ এলাকা উপযোগী কৃষি উন্নয়নের জন্য আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ, যেখানে পানি ও সময়ের অর্থনৈতিক দিকটি যথাযথভাবে বিবেচনা করা। ফসল বৈচিত্র্যায়নে জোর দেয়া; ঞ) কৃষি ক্ষেত্রে জিনগত পরিবর্তন, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রবর্তন ও চর্চা করা, যেখানে খরাপ্রবণ, জলাভূমি, পাহাড় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারসহ আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উৎসাহিত করা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত, জলমগ্নতা ও অন্যান্য ঘাতসহিষ্ণু ফসলের জাতের প্রচলন করা; ট) সেচ ব্যয় কমিয়ে আনতে আন্তঃমন্ত্রণালয়/আন্তঃসংস্থার সমন্বয় এবং সবার অংশগ্রহণে কৌশল প্রণয়ন ও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ;আমাদের উৎপাদনশীল আধুনিক কৃষির দিকে ধাবিত হতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে আমাদের গতানুগতিক কৃষি থেকে বেরিয়ে এসে আরো গতিশীল কৃষির দিকে ধাবিত হতে হবে। তার জন্য চাই কার্যকর ও দক্ষ বাজার ব্যবস্থা। জিডিপির অনুপাতে কৃষির অবদান ধারাবাহিকভাবে কমে যাবে একথা সত্য, তবে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষির গুরুত্ব অদূরভবিষ্যতে হ্রাস পাবে না; বরং বৃদ্ধি পাবে। নেদারল্যান্ডসের মতো ক্ষুদ্র উন্নত দেশ এখনো প্রতি বছর ১২০ বিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস ব-দ্বীপ দেশ। বাংলাদেশের এ দেশ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কৃষির জন্য তা বেশি সত্য। সে কারণে আমরা শতবর্ষব্যাপী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ গ্রহণ করেছি। এখন তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি আধুনিকীকরণের দিকে ধাবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে।
ড. শামসুল আলম: প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ
Leave a Reply