৫০ বছর আগে নাগরিক ও পর্যবেক্ষক উভয়েরই উদ্বেগের প্রধান বিষয় ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। পাঁচ দশকের মাথায় একটি দারিদ্র্যপীড়িত দুর্যোগপ্রবণ, দুর্বল অর্থনীতির দেশ টেকসই অর্থনৈতিক রূপান্তরের অসাধারণ একটি প্রতিপাদ্য সব মহলের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এ অর্জন রাতারাতি হয়নি, হঠাৎ করেও নয়। কিন্তু পরিবর্তনের গাথা অনস্বীকার্য ও গভীর। তাই পরবর্তী ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ শক্তির জায়গা থেকেই মধ্যম আয় তথা আরো উন্নত অর্থনৈতিক স্তরে পৌঁছার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র যতটা পরিষ্কার, রাজনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে চিত্রটি ভিন্ন ও আশাব্যঞ্জক নয়। অথচ স্বাধীনতার পরপর রাজনীতিকেই কম চ্যালেঞ্জের মনে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক উন্নয়নের যেই ঘাটতি অনুভূত হচ্ছে, তা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক সমাজের স্বপ্ন নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রতিনিধিত্বমূলক অধিকারগুলো মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, যেমন হয়েছে সব জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠানগুলোও। এ ধরনের রাজনৈতিক অবক্ষয় জবাবদিহিহীন ক্ষমতা, ব্যাপক স্বজনপ্রীতি কাঠামোগত দুর্নীতিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
তবে বর্তমানের এ বৈপরীত্যে ভরপুর চ্যালেঞ্জের আলোচনায় আসার আগে পেছনটা ভালো করে দেখা যাক। পাঁচ দশকে বাংলাদেশের উঠে আসার গল্প নানাভাবে, নানা সূচকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত সূচকের পরিসংখ্যানগত আলোচনা আসলে বাংলাদেশের রূপান্তরের ব্যাপ্তি ও গভীরতাকে সুবিচার করে না। পাঁচটি কাঠামোগত রূপান্তর এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
প্রথম গভীর ও কাঠামোগত রূপান্তর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়। দুর্যোগের শিকার—এ প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তির কালো ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বদরবারে সব দুর্যোগের ব্যবস্থাপক হিসেবে সর্বজন মহলে স্বীকৃতি পাওয়া সত্যি এক বিরল অর্জন।
দ্বিতীয় রূপান্তর খাদ্যনিরাপত্তায়। জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। আবাদযোগ্য জমি কমেছে বৈ বাড়েনি। এ বাস্তবতায়ও খাদ্য উৎপাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। নিরক্ষর কৃষক প্রযুক্তির সুযোগ খোলামনে ও মহোৎসাহে গ্রহণ করেছেন। কৃষি বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ধানের ভ্যারাইটি ও অন্যান্য শস্য উদ্ভাবনের ধারাবাহিক কাজ করে গেছেন। আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কাঠামো ভেঙে বাজার ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের এই ধারাবাহিকতায় তাই প্রবৃদ্ধির অন্বেষণে কোনো সময় বড় কোনো হোঁচট খেতে হয়নি।
তৃতীয় রূপান্তরমূলক কৃতিত্ব হলো অবকাঠামোগত প্রান্তিকতার অভিশাপ দূর করা এবং বিচ্ছিন্ন গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত গ্রামপ্রধান একটি দেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত একটি সংযুক্ত জাতীয় অর্থনীতিতে রূপান্তর করা, যেখানে উদ্যোক্তা ও শ্রমিক উভয়ই ‘বিদেশকে’ একটি অন্যতম অর্থনৈতিক গন্তব্যে রূপান্তর করেছে।
চতুর্থ রূপান্তরমূলক অর্জন নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উত্থান, যদিও আরো গভীর ক্ষমতায়নের লড়াইটা এখনো বাকি রয়ে গেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার, ক্ষুদ্রঋণে প্রবেশাধিকার এবং নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এ ধরনের রূপান্তরকে সম্ভব করেছে। জন্মহার হ্রাসও একটি রূপান্তরমূলক অর্জন। আমার নিজস্ব গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির এক-তৃতীয়াংশ জন্মহার হ্রাসের কারণে।
প্রবৃদ্ধির প্রচলিত অর্থনৈতিক বয়ান বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বপ্রচারিত আখ্যান উল্লিখিত রূপান্তরগুলোর কারিগর বা চালককে তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করে না। তুলনামূলকভাবে যে বিষয়টি জাতীয় আলোচনায় সেভাবে উঠে আসেনি তা হলো, সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব ও ব্যক্তিত্বে স্বাধীনতার গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব। এটি হলো পঁঞ্চম রূপান্তর একটি ভঙ্গুর পরিবেশ ও অদৃষ্টবাদে নিমজ্জিত দরিদ্র জনগণ, যাদের রয়েছে পরনির্ভরশীল মনোভাব, তারা একটি ব্যক্তিত্বের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গেছে। তারা হয়েছে আরো দৃঢ়, সুযোগের প্রতি সক্রিয় এবং জীবনের লক্ষ্যে আরো স্পষ্ট। অদৃষ্টবাদ আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এ মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে একজন নিরক্ষর কৃষক প্রযুক্তির আশীর্বাদকে আলিঙ্গন করেছেন, গ্রামীণ যুবকদের বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সুযোগ অন্বেষণ করতে দেখা যাচ্ছে, দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের আহ্বানে সাড়া দিতে দেখা যাচ্ছে এবং অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস করতে দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিপ্লবকে স্বীকার না করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রূপান্তরের যেকোনো ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
পরিবর্তনের আরেকটি চালক ছিল সমাধানকেন্দ্রিক উদ্ভাবনের তৃণমূল সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর ‘জাতি নির্মাণ’ একটি সংকীর্ণ অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে থেকে যায়নি, বরং জনপ্রিয় হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়কালে বাংলাদেশে এনজিওগুলোর জন্ম হয়েছিল, তবে উদ্ভাবনের সন্ধান শুধু এনজিও সেক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শেষ পর্যন্ত বহুক্ষেত্রগত আগ্রহে পরিণত হয়েছিল। ক্ষুদ্রঋণ, সংযোগ সড়ক, ওষুধনীতি, সামাজিক বনায়ন, শর্তসাপেক্ষ নগদ অর্থ স্থানান্তর, নতুন ফসলের জাত, সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারসহ উদ্ভাবনের তালিকা ফলপ্রসূ এবং ধারাবাহিক উভয়ই হয়েছে।
রাজনীতিও পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালক ছিল। সাধারণ রাজনীতি নয়, বরং স্থানীয় ও জাতীয় উভয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনীতি এটা করেছিল, যেটি ১৯৯০ থেকে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। এটা সত্য যে এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা সৃষ্টি ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি রাজনৈতিক নবায়নের অন্যতম একটি বাস্তবতা নিশ্চিত করেছিল। যেখানে আনুষ্ঠানিক জবাবদিহিতার প্রক্রিয়াগুলো এখনো তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি, সেখানে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতিই জবাবদিহিতার বলতে গেলে একমাত্র নিয়ামক হিসেবে কাজ করছিল।
বাংলাদেশের রূপান্তরে পরিবর্তনের আরো দুটি স্বল্প পরিচিত চালক সাহায্য করেছিল। যদিও রাষ্ট্রের একটি বড় প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতি রয়েছে, যা প্রধানত ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার, স্বাধীনতার পর তা দায়বদ্ধ শাসন ও নীতি এবং নেতৃত্বের বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে পারেনি। রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলের মধ্যে এ ধরনের ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ আশ্চর্যজনকভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নীতিগত সংস্কার করতে সক্ষম হয়েছে, যেগুলো বৃহত্তর কাঠামোয় প্রভাব ফেলেছে। ১৯৮০-এর দশকের ওষুধ নীতি, ১৯৯০-এর দশকের ব্যাংকিং সংস্কার, ২০০০ ও ২০১০-এর দশকের টেলিযোগাযোগ, ডিজিটাল সংস্কার এবং শর্তসাপেক্ষ নগদ অর্থ স্থানান্তর (কনডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার), যা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার এমডিজি অর্জন নিশ্চিত করেছিল। এগুলোর প্রত্যেকটি সম্ভব হয়েছিল এক ধরনের সফল নীতি উদ্যোগের মাধ্যমে। পলিসি মেকার, এনজিও, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক ধরনের সাময়িক পলিসি কোয়ালিশন এ ধরনের নীতি উদ্যোগগুলোকে মাঠে আনতে ও কার্যকর রূপ দিতে ভূমিকা রেখেছিল।
বাংলাদেশে আরো একটি রূপান্তরের চালক ক্রিয়াশীল ছিল। মাঠ বাস্তবতা সচেতন উন্নয়ন ডিসকোর্সও বাংলাদেশের পরিবর্তনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। চরম দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষির আধুনিকীকরণ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন ডিসকোর্স সুনির্দিষ্ট নীতি পদক্ষেপ চিহ্নিত করতে ভূমিকা রেখেছে।
৫০ বছরের অর্জনের উপাখ্যান সমাপ্ত করে এখন সময় সামনে তাকানোর। সমৃদ্ধি, সাম্য ও মর্যাদার স্বপ্নে উজ্জীবিত এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া একটি জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার পরিধি কোনো একক গোষ্ঠীর বিষয় হতে পারে না। আজকে স্বপ্ন দেখাটাও একটি সম্মিলিত কাজ হতে হবে, যেখানে সব গোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা সম-অধিকার ও সমমর্যাদায় জায়গা করে নিতে পারবে। নতুন ৫০ বছরের শুরুতে তাই রাজনীতি ও অর্থনীতি সংযোজিত হয়ে ভবিষ্যৎ দেখার এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।
৫০ বছরের যাত্রার মধ্যে দুই দশক বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথের পরিপ্রেক্ষিতে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ দশকগুলোর বোঝাপড়া মূল্যায়ন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনীতি ও অর্থনীতির এই সংযোগ আগামী দশকগুলোয় উন্নয়নের ফলাফলকে কীভাবে রূপ দিতে পারে তা জানা। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল ১৯৯০-এর দশক। চারটি অসামান্য পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য বিষয়টি পরিষ্কার করেছে এবং এ দশকটিকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য একটি গতিশীল আন্তঃক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছে। সেগুলো হচ্ছে বাজার অর্থনীতি ও প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের একটি বিস্তৃত আদর্শিক আলিঙ্গন, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতি, নীতি উদ্যোক্তার একটি শক্তিশালী স্রোত এবং তৃণমূল রূপান্তরের ওপর গুরুত্ব দিয়ে গতিশীলতা তৈরি। পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলোর এ সম্মিলন প্রবৃদ্ধির ত্বরণ, এমডিজির দ্রুত উপলব্ধি এবং সেই সঙ্গে ‘ব্রেন ড্রেন’ থেকে ‘ব্রেন গেইন’-এ স্থানান্তরকে উৎসাহিত করার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
২০১০-এর দশকে অবশ্য একটি বিপরীত ধরনের টার্নিং পয়েন্ট দেখা গেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির গতি অব্যাহত রয়েছে এবং ‘মধ্যম আয়ের’ দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে, দশকটি নির্দিষ্ট জটিল পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলোর বিপরীত দেখা গেছে। উন্নয়নের ফলাফলের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকৃতি তিনটি স্বতন্ত্র বিপরীতমুখী বিষয় প্রত্যক্ষ করেছে—ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য, ঢাকা বনাম বাকি অঞ্চল—এ ধরনের স্থানিক বৈষম্য এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যুবকের বর্তমানে কর্মসংস্থান নেই; না তারা শিক্ষায় আছেন না প্রশিক্ষণে—এমন একটা সংকট চলছে। দারিদ্র্য হ্রাস-বৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা মন্থর হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের পরিবর্তে স্বজনপ্রীতিমূলক পুঁজিবাদ প্রসার পাচ্ছে। স্কুলে তালিকাভুক্তির অগ্রগতি মানসম্পন্ন শিক্ষায় রূপান্তর হয়নি। মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপনে সংগ্রাম করছে। এমনকি নারীরা যখন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তখন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অযোগ্য প্রশাসনের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি আশকারা পেয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পায়ে শিকল পরিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের যাত্রা এভাবে নানা জটিলতায় ভরপুর। পরিবর্তন অবশ্যই গভীর এবং বাস্তব হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ ধারাবাহিকভাবে কম অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মধ্যম আয়ে উত্তরণের গুণমানসম্পন্ন উন্নয়নে চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে অনিশ্চয়তা প্রদর্শন করে। একসময়ের প্রতিশ্রুতিশীল দেশগুলোর ভাগ্য (দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন) তথাকথিত মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার ক্ষেত্রে একটি কঠোর সতর্কতা হিসেবে সামনে এসেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার পরবর্তী পর্যায়ে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বেসরকারি খাতের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা এ ভূমিকা কতটা কার্যকর থাকবে তার উত্তর দেয়। এর আগে আমাদের রাষ্ট্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি খাত এবং স্বচালিত বেসরকারি খাত ছিল। এখন একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা প্রমাণ করার চেয়ে ক্ষমতার নৈকট্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধু ক্ষমতার নৈকট্যই নয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয়ই ক্ষেত্রেই ক্ষমতার উচ্চ সারণিতে অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বেসরকারি খাতের পদ্ধতিগত অগ্রাধিকারগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার প্রতি কম এবং ক্ষমতাসীন শক্তির সমর্থন থেকে সুবিধা নেয়ার দিকে বেশি মনোযোগী বলে মনে হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতির লাভজনক ক্ষেত্রগুলো সিন্ডিকেট বা মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো, অস্পষ্ট ‘বেসরকারি খাতের’ স্বার্থের আপাত সুবিধার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে উপেক্ষা করা। এটি কি একটি নতুন টার্নিং পয়েন্ট?
‘মধ্যম আয়’ আকাঙ্ক্ষার একটি সংকীর্ণ অভিজাত কাঠামো, যা বাংলাদেশী সমাজের অন্তর্ভুক্তি ও আত্মমর্যাদার গভীর লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বা অভিজাত এ বয়ানটি উচ্চৈঃস্বরে সমর্থন করা প্রবৃদ্ধির উদ্দেশ্যগুলোর জন্য বিশেষভাবে কার্যকর নয়। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সূচকে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের ওপর নজর দিলে সেই সূচকগুলোয় মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যায়, যেগুলোর ওপর মধ্যম আয় আকাঙ্ক্ষার ত্বরান্বিত উপলব্ধি নির্ভর করে, যেমন প্রতিষ্ঠান, সরবরাহ, দক্ষতা, শ্রমবাজারের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি এবং আইনের শাসন। এটা এমন নয় যে এ দুর্বলতাগুলোর কোনোটাই স্বীকৃত নয়। নীতি প্রচুর, প্রকল্প প্রচুর। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য সংস্কার ও অগ্রগতি জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাছে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাগরিকরা নির্বিকার থাকে।
বাংলাদেশ যদি তার প্রতিষ্ঠালগ্নের স্বপ্নের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে চায় তাহলে ‘মধ্যম আয়ের’ স্বপ্নকে গণতন্ত্রীকরণ করা একটি চ্যালেঞ্জ।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নির্বাহী চেয়ারম্যান, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
Leave a Reply